শাহবাগের আন্দোলনের প্রতি সংহতি: সারা দেশে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে জাতীয় সংগীত। উড়ল জাতীয় পতাকা

সারা দেশের সব ধরনের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে গতকাল উড়ল জাতীয় পতাকা, একযোগে। রাজধানীসহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সংহতির এ কর্মসূচি পালন করা হয়। আর সবার দাবি ছিল মানবতাবিরোধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা।

ঢাকার মতো চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা,সিলেট, রংপুর, গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালী, নীলফামারী, নোয়াখালী, রাঙামাটি, বাগেরহাট, নাটোর, কুড়িগ্রাম, ভোলা, মৌলভীবাজার, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেটের বিশ্বনাথ, কুমিল্লার দেবীদ্বারসহ দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একইভাবে কর্মসূচি পালন করা হয়।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাসহ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে তারুণদের নেতৃত্বে চলা গণজাগরণের ১৩তম দিনে দেশব্যাপী এ কর্মসূচি পালিত হলো। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হওয়ার পরপর তাৎক্ষণিকভাবে শাহবাগের এই আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন এখন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের চলমান আন্দোলন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই চলবে।

রাজিব হায়দার খুনের ঘটনায় জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি জানান ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার। এ ছাড়া জামায়াত-শিবির ঘোষিত আগামী সোমবারের হরতাল প্রত্যাখান করে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কল-কারখানা খুলে রাখতে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। জামায়াত-শিবির বাধা দিতে আসলে তাদের প্রতিহত করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।



*আলুব্দী গ্রামের এক মেয়ের কথা:
কাদের মোল্লাকে ফাঁসি নয় যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। অনেকেই এই রায়কে লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছেন। প্লীজ আপনারা লজ্জা পাবেন না। লজ্জাকে তালাবন্দ করে রাখুন। প্লীজ কিছু করুন।

বিশাল একটা পরিবার আমাদের। আমার দাদারা ছিল ৮ভাই ১বোন। আমার কতজন কাজিন আছে তার সঠিক সংখ্যা আমার অজানা। এমনকি সব চাচাকেও আমি চিনি না। তবে পেপারে যখন পড়েছিলাম আলুব্দি গ্রামের সাফি মোল্লা, আমির হোসেন মোল্লা কোন এক রাজাকারের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিচ্ছে তখন আব্বুর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম এরা আমার জ্যাঠা হন। খুশি হয়েছিলাম একটু হয়তো গর্বও হয়েছিল সেদিন আমার।

দিনের বেলা টিভি খুব একটা দেখা হয়না আমার। ভেবেছিলাম জামায়ত হয়তো হরতাল ডেকেছে বিচার বন্ধের দাবীতে। কাদের মোল্লার ফাঁসি নয় যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছে এই খবরটা পেয়েছি তাই অনেক দেরীতে। যখন শুনেছিলাম তখনই অনেক খারাপ লাগেছিল এবং তখনো আমি জানোয়ারটার ফাঁসির দাবির পক্ষে ছিলাম।

১৯৭১ সালে আমদের গ্রামে পাকিস্তানিরা হামলা চালায়। লুট করে আমার দাদীদের গহনা, পুড়িয়ে দেয়া হয় ধানের গোলা, গুলি করে মারা হয় হালের বলদগুলোকেও। আমার দাদা মসজিদে গিয়েছিলেন নামায পড়তে। যেই জামায়াত ধর্ম নিয়ে এত মায়া কান্না করে, শুধুমাত্র ধর্মের জন্য যারা আজো পাকিস্তানকে সাপোর্ট করে; তাদের সেই প্রিয় ধার্মিক ভাইরা মসজিদ থেকে ধরে নিয়ে যায় আমার দাদাকে। তারই আরেক ভাইয়ের (হাচ্চু মাদবর) চোখের সামনে খুন করা হয় তাকে(নয়া মিঞা মাদবর) এবং তার আরেক ভাই(বাঁশি মাদবর)কে । গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবেরের সন্তান ছিলেন তারা কিন্তু জানাযার ভাগ্যটা পর্যন্ত তাদের হয়নি। আমার বাকি দাদাদের হাজারো কাকুতি মিনতি সত্বেও লাশ ফেলে দেয়া হয় এক কুয়াতে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে যেয়ে হাতে গুলি খান আমার নানা। যুদ্ধের নয়টা মাস অবর্ননী্য় যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছে আমার পরিবার। যার বিবরণ শুনলে এখনো ভয়ে শিউরে উঠি।

যুদ্ধের পর আমদের পরিবার কখনো সরকারের কাছে কোন সাহায্য চাইতে যায়নি। তবে সরকার এসেছিল আমদের গ্রামের মানুষের জমি অধিগ্রহন করতে। বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, আগুন্দা, ক্যান্টেনমেন্ট সব মিলিয়ে প্রায় ৮০০ বিঘা জমি অধিগ্রহন করে নেয় সরকার তৎকালীন বাজারদরে। এখন সেই জমির দাম বেড়ে গেছে কয়েকশ গুন। আমার দাদাদের থেকে অধিগ্রহন করা জমিতে আজ সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে মিরপুর ক্যান্টেনমেন্ট। সারা জীবন যারা চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন জমি হারানোতে তাদের কি অবস্হা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তারপরও সরকারের কাছে আমদের কিছুই চাও্য়ার ছিল না। ছিল না এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ। আল্লাহর রহমতে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। হারানো প্রতিপত্তি ফিরে না পেলেও সমাজে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য সবই অর্জন করতে পেরেছে আমাদের পরিবার। এতেই আমরা তুষ্ট ছিলাম।

কিন্তু এখন আমরা তুষ্ট নই। আর আমরা চুপ করে থাকতে পারছিনা। যুদ্ধের কারনে আমাদের পরিবার সব হারিয়েছিল। সহায় সম্পত্তি থেকে শুরু করে মান সম্মান মানসিক শান্তি স-ব-ই। কিন্তু আপনজন হারানোর বেদনা যে কত তা তো পরিমাপযোগ্য নয়! এই যুদ্ধ যারা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়াছিল তাদের সবাইকে হয়তো শাস্তি দেয়া যাবেনা। কিন্তু যেসব রাজাকার তাদেরকে সাহায্য করেছিল তাদের বিচার দাবী করাটা কি খুব বড় চাওয়া হয়ে গেল? আমার দাদী ৪১বছর ধরে বিধবা। বয়স হওয়ার পরও সে ভোট দিতে যা্য় শেখের বেটিকে (শেখ হাসিনা)।


শুধুমাত্র একটা আশায় যে হয়তো তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করাতে পারবেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের পরিবারের হত্যাকরীদের বিচার করিয়েছেন। হত্যাকরীদের ফাঁসির রায় হয়েছে। তাহলে আমার এলাকার ৩৪৪ জন মানুষকে হত্যাকারী নরপশুটার কেন ফাঁসি হবে না? ১৯৭১ সালে কাদের মোল্লা, আমির গুন্ডা এবং মন্ডল অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে মিরপুরবাসীর উপর। শুনেছি আলুব্দির মানুষের উপর বর্বরতা চালানোর নেতৃত্বে ছিল আমির গুন্ডা এবং কাদের মোল্লা। আমির গুন্ডা ১২বছর জেল খেটে পাকিস্তানে চলে গেছে। কিন্তু কাদের মোল্লা ছিল বহাল তবিয়াতে। এখন তাকে দেয়া হচ্ছে যাবজ্জীবন কারাদন্ড। এই নরপশুটা যে ৪১ বছর বেঁচে ছিল সেটাই তো অনেক বেশি। আমরা সরকারের কাছে কোন সংবর্ধনা চাইনা, চাইনা কোন টাকা পয়সা, এমনকি চাইনা কোন কোটা সুবিধা। শুধু চাই এই নরপশুটার সঠিক বিচার হোক।

'৭১এ যেসব দেশ আমদের সাহায্যের বদলে বিরোধিতা করেছে কেন তাদের প্রেশারে এদের শাস্তি লাঘব করা হবে? সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে যে এই যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামি যে মুক্ত হয়ে যাবে না তার কি কোন গ্যারান্টি আছে? কত মানুষকে খুন করলে আর কত্তটুকু বর্বরতা চালালে ফাঁসি দেয়া হবে? যে শহরের বাতাস থেকে আমরা অক্সিজেন গ্রহন করি সেই বাতাস থেকেই এই নরপশুটা এখনও অক্সিজেন নিচ্ছে! লাক্ষো শহিদদের আত্মত্যাগকে জুতোপেটা করে ক্ষমতার অট্টহাসি হাসছে! এসব ভেবে কি আপনাদের মন বিষিয়ে উঠে না? ঘৃনায় রি রি করে না? প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করে না? নাকি আমরাও শীতল রক্তের সরীসৃপ হয়ে গেছি!


যারা এই লেখা পড়ে ভাবছেন বর্বরতা তো আমার পরিবারের সাথে হয়েছে আপনার কি। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি ১৯৭১এ আমার পরিবারের উপর যে নৃশংসতা হয়েছে ২০১৩ তে আপনার পরিবারের সাথেও এমন হতে পারে। আজ যদি আপনারা আমাদের পাশে না দাঁড়ান আপনার বিচার দাবীর সময়ও হয়তো আপনি কাউকে পাবেন না। তাই সবাইকে বলছি একজোট হন। '৭১ এ একজোট হয়ে পাকিস্তানিদের হারিয়ে দিয়েছি আমরা তবে এখন কেন ওদের দোসরদের শাস্তি দিতে পারবো না! তাই সবার কাছে অনুরোধ ৪১বছর অনেক চুপ করে থেকেছি আর না। প্লীজ এবার আওয়াজ উঠান।

0 comments:

Post a Comment

Copyright 2010 Mipur Pallabi
NK powered by NK™ template by NK