সারিকা কে যেদিন প্রথম দেখি, সেদিনই মনে হয়েছিলো আমি বোধহয় তার জন্যই জন্মেছি। নজর কাড়ার মতোই ছিলো সে। প্রথম দেখেছিলাম আমাদের গ্রামের বাড়িতে। আমার এক চাচার বন্ধুর মেয়ে। খুলনা শহরেই পড়ে। সরকারী আযম খান কমার্স কলেজে বিবিএস অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ে সে।

আমি তখন ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র। খুলনাতেই পড়ি। গ্রামের বাড়িতে খুব কম যাওয়া হতো আমার। ঘরকুনো আমি বাইরে যেতেই চাইতাম না। বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও কম। অনেকেই আড্ডাটা ভীষণ উপভোগ করতো। আমি সেটাও পারিনি। চুপচাপ ঘরে বসে বই পড়তেই ভালো লাগতো।


সারিকাকে দেখে খুব ভালো লেগেছিলো। কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনি। মেয়েদের সাথে কথা বলতে ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করতাম। সেবার আমার চাচাতো বোনের বিয়েতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। গতানুগতিক ভাবেই ওই বিয়ের অনুষ্ঠানেই আমি সারিকা কে দেখি। ভীষণ ভালো লেগেছিলো প্রথম দেখাতেই। আমার বোন সারিকার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। সারিকা শুনে খুবই অবাক হয়েছিল যে আমি খুলনা থাকি। আমিও বিস্মিত হয়েছিলাম যে সেও খুলনা থাকে। পরিচয় পর্ব শেষে আমি আমার মতো চুপচাপ বসে ছিলাম, আর দেখছিলাম সে তার ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে। যতই দেখি মুগ্ধ হয়ে ভাবি মানুষ এতো সুন্দর কিভাবে হতে পারে? উপমা দিতে ইচ্ছে করছেনা তার ব্যাপারে। ওর মুখের দিকে তাকালে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে, চোখের দিকে তাকালে বিলীন হয়ে যাই আমি। ওর সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলতে পারছিলামনা। নিজেকে কন্টোল করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। সারিকা কয়েকবার এসেছিলো কথা বলতে, কিন্তু আমি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারিনি। ও হাসতে হাসতে আমাকে বলে, আপনি কি সবসময় এরকমই?

আমি কী করে তাকে বোঝাই যে তাকে দেখেই আমার এই অবস্থা।

মানুষ বোধহয় এইভাবেই প্রেমে পড়ে। ঐ কয়েকটা দিন আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিলো। সারিকাকে শয়নে স্বপনে কল্পনা করে চলেছিলাম নিজের মতো করে। নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে এরকম অসাধারন সুন্দরী অপ্সরী নিশ্চয়ই এতোদিন আর একলা নেই। আমার আত্নকেন্দ্রিকতার কারনেই কিনা জানিনা, সারিকা আমার সাথে বারবার কথা বলতে চাইতো। ও কে কী করে বোঝাই ওর কারণে আমার এই অবস্থা। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ, এখন বিদায় নেবার পালা। সারিকা ও চলে যাচ্ছে। ওরা গাড়িতে ওঠার আগে অনেকক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমি আড়চোখে বারবার দেখছিলাম। মনটা খারাপ লাগছিলো। আমি তো আমার মনের কথা বলতে পারতাম। আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা কে জানে? অন্ততঃ সে তো জানতো তাকে কেউ অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলো।


বিয়ের পর বোনের বাসায় বেড়াতে গেলাম। ওর সাথে আমার অনেক বেশী হৃদ্যতা ছিলো। ওর বিয়ের ছবিগুলো দেখছিলাম। সারিকার ছবিগুলো বারবার দেখছিলাম। আমার বোন সেটা খেয়াল করেছিলো। হঠাৎ করেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, এই, সারিকাকে তোর কেমন লাগে? ওর এই হঠাৎ প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে যাই আমি। ও বোধহয় সেটা বুঝতে পেরেছিলো। আমি বললাম, হঠাৎ এই প্রশ্ন করলি কেন? ও বলে, তুই সেই তখন থেকে সারিকার ছবি গুলোই বারবার দেখছিস। আমার কাছে লুকাচ্ছিস কেন?


আমি অপ্রস্তুত ভাবে হেসে বললাম, তুই আমার সবথেকে কাছের বন্ধু। তোর কাছে লুকানোর কিছু নেই। আমার মনে হয় ওকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। তারপর ওকে বিস্তারিত বললাম। ও তো হাসতে হাসতে লুটোপুটি। আমি বললাম, হাসছিস কেন? ও বলে, আগুন তো দুই দিকেই ধরেছে দেখি। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। তার মানে কি সারিকা ও কি আমাকে..............................!!!! নিজেকে তখন সব থেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছিলো। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সারিকা কি তোকে কিছু বলেছে? ও বলে, বলেনি আবার? সেই বিয়ের দিন থেকে শুনে আসছি। আমি আছি যন্ত্রনায়। বলেও দিয়েছি তোর কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক নেই। তারপর থেকে তোর মোবাইল নম্বরের জন্য আমার মাথা খারাপ করে ফেলেছে। আমি এখনো দেইনি। আফটার অল, তোর ভিউটা তো জানতে হবে। এখন তোর ভিউটা জানলাম। তুই চাইলে ওর মোবাইল নম্বরটা রাখতে পারিস, আমি তোরটাও ওকে দিয়ে দিবো।


নম্বরটা মোবাইলে সেভ করে নিলাম। এখন কথা বলে হবে। কিভাবে বলি? আমার তো মেয়েদের সামনে গেলেই বুক ধরফড় শুরু হয়ে যায়। শেষমেষ এসএমএস পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। রাত ২টার দিকে একটা এসএমএস পাঠালাম যাতে লেখা ছিলো "আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু হয়তো আপনি ঘুমিয়ে গিয়েছেন। তাই এসএমএস পাঠালাম। কেমন আছেন?"


৩০ মিনিট পরে ঐ নম্বর থেকে কল আসলো। ঘুম ঘুম চলে এসেছিলো, তবে নম্বরটা দেখে ধড়মড় করে উঠলাম। রিসিভ করেই বললাম, কেমন আছেন? ওপাশ থেকে উত্তর আসলো, আপনি তো মানুষ ভালো না। এতো রাতে মেয়েদের বিরক্ত করেন। আমি কনফিউজড হয়ে গেলাম। ভাবলাম রং নাম্বার নাকি? আমতা আমতা করে বললাম, ভেবেছিলাম এটা আমার এক পরিচিত একজনের নাম্বার। তাই মেসেজ পাঠিয়েছিলাম। ও ফিক করে হেসে ফেললো। সারিকা কে যতটুকু দেখেছি এরকমই মনে হয়েছে। তারপর একটু একটু করে কথা বলা শুরু হলো। কথা আর শেষ হতে চায়না। যখন ব্যালান্স শেষ হলো তখন হুশ হলো যে আসল কথাটাই তো বলা হলোনা। আমি কলব্যাক করলাম। ও রিসিভ করে বললো আপনাকে একটা কথা বলা দরকার ছিল, সেটা বলা হয়নি। আমি বললাম, আমারো একটা কথা বলা দরকার ছিলো।


ও বললো, ঠিক আছে, আপনি আগে বলেন। আমি বললাম, কথাটা কীভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা। তাছাড়া আপনিই বা কীভাবে নিবেন সেটাও তো জানিনা...............আসলে যেদিন প্রথম আপনাকে দেখেছি সেদিন থেকেই আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে। আপনাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। জানি এইভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করাটা ভালো দেখায়না। তাছাড়া এটা আমার স্বভাবেও নেই। কিন্তু মনকে আর মানাতে পারলাম না। আপনার উত্তরের অপেক্ষা করছিনা। শুধু আমার মনের ভাবটা আপনাকে জানালাম। ভালো থাকবেন। ফোন রেখে দিলাম।


কিছুক্ষন পর আমার মোবাইলে অন্য একটা নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এলো। সেটাতে লেখা ছিলো,"শুধু নিজের কথা বলে রেখে দিলেন, আমার মনের কথাটা শুনতে চাইলেন না? আমি খুবই চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে সেটা বোধহয় বুঝতে পেরেছেন। প্রথম দেখা থেকেই আপনার প্রতি একটা কৌতুহল ছিলো। আপনি নিজেকে গুটিয়ে রাখেন সেটা খেয়াল করেই আপনার আরো কাছে আসতে চাইতাম। আপনি আরো গুটিয়ে যেতেন। আমার মজাই লাগতো আপনাকে বিরক্ত করতে। এভাবে করতে করতে কখন যে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি নিজেও জানি না। সরাসরি মনের কথা বলে ফেললাম, পারলে ক্ষমা করবেন।"


মেসেজটা পেয়ে নিজেকে অনেক সুখী মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো স্বর্গ আমার হাতে পেয়েছি। যে কথাটা বলতে আমার এতো ইতস্ততঃ বোধ হচ্ছিলো সেটা সে কত অবলীলায় লিখে দিলো। সেই থেকে শুরু। এখনো চলছে আমাদের প্রেম। সারিকা কে পেয়ে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মনে হয় নিজেকে। আমার পরিবার আজ সম্পূর্ণ। বাবা-মা, আমি, সারিকা আর আমাদের একমাত্র সন্তান রিমঝিম। কীভাবে হলো? সেটা না হয় আরেকদিন বলবো। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে আমার একটাই প্রার্থনা তিনি যেন আমাদের সবসময় এরকম সুখী রাখেন।


[লেখাটা অনেক বড় হয়ে গেল। যেসকল পাঠক ধৈর্য্য ধরে লেখাটা পড়েছেন তাদের অনেক ধন্যবাদ। আমার লেখার হাত মোটেও ভালো না। শুধু চেষ্টা করে যাচ্ছি।]

0 comments:

Post a Comment

Copyright 2010 Mipur Pallabi
NK powered by NK™ template by NK